হাতিয়ার "এ.এম উচ্চ বিদ্যালয়ে" প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগ

ছায়েদ আহমেদ, হাতিয়া

প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৩৭ এএম


হাতিয়ার "এ.এম উচ্চ বিদ্যালয়ে" প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগ

ছবিঃ সংগৃহীত

একাত্তর পোস্ট অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বাংলাদেশের চাকুরী বিধি অনুযায়ী শিক্ষক'রা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না কিংবা শিক্ষকতা থাকা অবস্থায় অন্য কোনো চাকরিও করতে পারবেন না। অথচ শিক্ষকরা এসবের তোয়াক্কা তো করছে না বরং তা আরো বাজে অবস্থার দিকে নিয়ে গেছে এটিকে এবং তাদের এ অনৈতিক প্রাইভেট-কোচিং ব্যবসা দেশের মূল শিক্ষা ব্যবস্থাকে নির্যাসহীন করে তুলেছে।

শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতেও প্রাইভেট বাণিজ্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মানা হচ্ছেনা "শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানে শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিং বানিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২"। সীমাহীন অর্থলোভী এসব শিক্ষকরূপি প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি সব শ্রেণীর শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার আব্দুল মোতালেব (এ এম) উচ্চ বিদ্যালয়ের এমনই এক চিত্র দীর্ঘদিনের। এক সময় স্কুলটির সুখ্যাতি ছিল, জৌলুস ছিল, এখন আছে কেবল নাম মাত্র ঐতিহ্যটি। আর এই ঐতিহ্যের নাম বেয়ে এবং হাতিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধাকে পুঁজি করে কোনমতে ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা হয়েছে গত ২০ বছর।

প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে যতটা না শিক্ষাকেন্দ্রিক তার চাইতে বেশি বাণিজ্যিক। প্রায় সব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট-কোচিং করতে হয়, না হয় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক হেনস্তার শিকার হতে হয়। ইংরেজি শিক্ষককে ইংরেজি না দিয়ে শারীরিক শিক্ষা এবং সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক'রা চালিয়ে নেন ইংরেজি ক্লাস। জোড়াতালি দিয়ে এসব শিক্ষকেরা ইংরেজিতে দক্ষতা প্রদর্শনের চেষ্টা করেন মাত্র। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে চাপ সৃষ্টি করা সহ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নানান খামখেয়ালিরও অভিযোগ উঠেছে। 

পাবলিক পরীক্ষার সময় হল নিয়ন্ত্রণ করে এবং সিন্ডিকেট কৌশলের মাধ্যমে কাঙ্খিত রেজাল্ট ছিনিয়ে আনার অভিযোগ রয়েছে নানা মহলের। এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক লেখালেখি করেছে এখানকার দায়িত্বশীল অনেকে।

চলতি বছরের ৬ মার্চ মঞ্জু রহমান তার ফেইসবুক আইডিতে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরেন। এর আগে মো.ইসমাইল হোসাইন ইলিয়াস তার ফেইসবুক আইডিতে তার ভাতিজা ৮ম শ্রেণীর ছাত্র মো.শাহীন উদ্দিনকে নির্যাতনের অভিযোগ এনে স্ট্যাটাস দেন। যেখানে উল্লেখ করা হয় প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত কৃষি শিক্ষার শিক্ষক নিজাম উদ্দিনের কাছে গণিত প্রাইভেট না পড়ায় সে ক্ষুব্ধ হয়ে সামান্য ছুতানাতায় শাহীনকে বেদম প্রহার করে। 

এদিকে, গেল বছরের ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা প্রাইভেট পড়েনি তাদের রেজাল্ট পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার অভিযোগে ৭ম শ্রেণীর ১৬ জন শিক্ষার্থী স্কুল ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী হাইস্কুলগুলোতে ভর্তি হন। এদের মধ্যে মাছুমুল বারি অনিম এর পিতা মোসাদ্দেকুল বারি (হাতিয়া ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক) জানান, এ এম স্কুলটি পুরোপুরি বাণিজ্য কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। আমার ছেলের রেজাল্ট সন্দেহজনক হওয়ায় উত্তরপত্র দেখতে চাইলে প্রধান শিক্ষক তা হারিয়ে গেছে বলে জানান।

মঞ্জু রহমান নামের এক গার্ডিয়ান তার ছেলের রেজাল্টেও দুর্নীতি হয়েছে বলে জানান। এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী লাবিবা ৬ষ্ঠ শেণীতে পড়া অবস্থায় শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকের কাছে ইংরেজি প্রাইভেট পড়তে রাজি না হওয়ায় তাকে পরিকল্পিত ভাবে এসেম্বলিতে মাইকের মাধ্যমে অপমান করার তথ্য পাওয়া যায়। 

এসব অভিযোগকারী ছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও অনেক ভুক্তভোগী জানান, সরকারি বেতন ভোগ করে এসব অর্থলোভী শিক্ষকেরা ক্লাসে ঠিকমতো পাঠদান না করে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রাইভেটমুখী করে তুলেছে। গাদাগাদি করে ব্যাচের পর ব্যাচ পড়ানোর কারণে সেই প্রাইভেটে গিয়েও তারা যথাযথ শিক্ষাদান সেবা পায় না। প্রাইভেট বাণিজ্যে আসক্ত এসব শিক্ষকেরা দায়সারাভাবে ক্লাস সেরে ছুটছেন প্রাইভেট পড়াতে। কখনো নিজের বাসা, কখনো ভাড়া করা কোচিং সেন্টার কিংবা স্কুলের রুমগুলোতে। 

এমনই অভিযোগের জের ধরে সোমবার সকল ৭টায় উক্ত হাইস্কুলের শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক আবু তোহা এবং সামাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক মো.সাইফুল্লাহ'র বাসায় (এ এম স্কুলের সন্নিকটে) সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে যায় এই প্রতিবেদক। এতে দেখা যায়, ৩৫-৪০ জন করে বসিয়ে প্রাইভেট পড়ানো হচ্ছে আর বাইরে অপেক্ষমান রয়েছে আরও ৩০-৩৫ জনের মতো। প্রাসঙ্গিক কিছু কথা জিজ্ঞেস করলে এই শিক্ষকদ্বয় জানান, ভোর ৬টা থেকে স্কুল চলাবস্থা এবং স্কুল ছুটির পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই প্রাইভেট কর্ম চলতে থাকে। 

২০০৩ সালে এই বিদ্যালয়ে যোগদানের পর ২০০৭ সালে বসবাস করা এই বাসা সমূহ ক্রয় করেন। এছাড়াও আশপাশে কোটি টাকার স্থাবর সম্পত্তিও ক্রয় করেছেন যদিও তারা বলেন, অল্প পয়সায় ক্রয় করেছেন এই সম্পত্তিগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই প্রাইভেট আসক্ত শিক্ষকেরা শিক্ষার্থী প্রতি ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা করে নেন এবং সুদের কারবারও করে আসছেন কয়েকবছর যাবত। 

এ বিষয়ে আবদুল মোতালেব (এ এম) উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসান বলেন, শিক্ষক'রা বাড়িতে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন না ঘুমাচ্ছেন এটা তাদের ব্যাপার আর ক্লাসে আমি কাকে কোন বিষয় দেবো সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। অথচ "শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানে শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিং বানিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২" বলছে ভিন্ন কথা। 

নোয়াখালী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুর উদ্দিন মো.জাহাঙ্গীর জানান, শিক্ষক'রা নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে পারবে না।

Link copied