শেভালিয়র উপাধি পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি পার্থ প্রতিম মজুমদার

সাখাওয়াত হোসেন, পাবনা

প্রকাশিত: ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০৭:৪৫ পিএম


শেভালিয়র উপাধি পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি পার্থ প্রতিম মজুমদার

ছবিঃ সংগৃহীত

একাত্তর পোস্ট অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

কবিতা মানেই কল্পনা; কবিতা পাঠ করা হয়, গীত হয়, আবার উপস্থাপক কিংবা আবৃত্তিশিল্পীর কণ্ঠে বাক্সময় হয়ে ওঠে কবির বক্তব্য ও শিল্পীসত্তা। কিন্তু নৈঃশব্দ্যের কবি! অর্থাৎ যিনি কিনা নিঃশব্দে কবিতা রচনা করেন, তাকে কীভাবে চিনবো আমরা! বা আরো সহজ করে বললে, একেবারে কণ্ঠ ছাড়া কি কবিতা হয়! কবিতায় কিছু বক্তব্য থাকে, আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, আর সেই প্রকাশভঙ্গির জন্যও তো শব্দশৈলীর দরকার হয়।

নিঃশব্দ নিয়ে পৃথিবীর জ্ঞানী ব্যক্তিগণ বিভিন্ন উক্তি দিয়ে গেছেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট মার্টিন লুথার কিং থেকে শুরু করে গণিতবিদ পিথাগোরাস- সকলেই নিঃশব্দের গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন এবং জীবনযাপনে এই নিঃশব্দের বিভিন্ন ব্যাখ্যা-ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছেন।

পিথাগোরাস বলেছিলেন, অর্থহীন কথা বা শব্দের চাইতে নীরবতা ঢের ভাল।

নীরবতাও যে এত গুরুত্ব বহন করতে পারে আর অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে, তার আরেক দৃষ্টান্ত মাইম। মুখে কোনো শব্দ না করে শুধুমাত্র দেহের ভাষায় যে শিল্পগুণ রয়েছে, তা মূকাভিনয়ের মাধ্যমেই উৎসারিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। মূকাভিনয় শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় মূক আর অভিনয়। অর্থাৎ নির্বাক অভিনয়। আর এই নির্বাক অভিনয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত একজন মূকাভিনেতা বাংলাদেশের পার্থ প্রতিম মজুমদার। এ কথা বললে বোধ করি অত্যুক্তি হবে না যে, তিনি বাংলাদেশের সর্বপ্রথম একজন যিনি মূকাভিনয়ের মাধ্যমে এ-দেশকে বিশ্বে পরিচিতি এনে দিয়েছেন।

জগদ্বিখ্যাত এই মূকাভিনেতা নিঃশব্দে দৈহিক ভাষায় নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দর্শককে আনন্দ দিয়ে থাকলেও, শৈশবে তাঁর দুরন্তপনার কোনো কমতি ছিল না। ১৯৫৪ সালের ১৮ জানুয়ারি পাবনার কালাচাঁদপাড়ায় তখনকার ফটোসাংবাদিক হিমাংশু কুমার বিশ্বাস এবং সুশ্রীকা বিশ্বাস দম্পতির ঘরে জন্ম নেন তিনি।

পার্থ প্রতিম মজুমদারের মূল নাম প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস। কণ্ঠশিল্পী বাপ্পা মজুমদারের বাবা পাবনার জমিদার ও প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গসঙ্গীতশিল্পী ওস্তাদ বারীণ মজুমদার ছিলেন তার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বারীণ মজুমদারের মেয়ে হারিয়ে যায়। তখন মেয়ে-হারানো বারীণ মজুমদারের অনুরোধে পার্থ ঢাকায় আসেন। তখন থেকেই তিনি পার্থ প্রতিম মজুমদার নামে পরিচিত।

অন্য আট-দশজন ছেলে মেয়ের মতো পার্থর পরিবারও ছিলো মধ্যবিত্ত। কিন্তু তাঁর বেড়ে উঠা একটু অন্যরকম। তাঁর জীবন চলা, স্বপ্নধারা, কাজের ধরন অনেকের কাছে গল্পের মতো। তবে সব কিছুতেই রয়েছে গভীর নিষ্ঠা ও দরদ। বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার মতো অর্থাৎ সময়কে মোকাবেলা করার মতো প্রচণ্ড কৌশলী পার্থ! বিষয়টি অনেককেই চমকে দিবে, ফেলে দিবে ভাবনায়। স্বপ্নগ্রস্ত মনে তৈরি করবে দেয়াল। কী করে তা সম্ভব? হ্যাঁ, স্বপ্নবাজরাই পারেন অসম্ভবকে সম্ভব করতে। সেটি তিনি করে দেখিয়েছেন।

পার্থের পড়াশোনা শুরু বাড়ি থেকে খানিক দূরে জুবিলী স্কুলে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষের পর বড় ভাইয়েরা তাকে কাকা শুধাংশু কুমার বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে কলকাতা শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে চন্দননগরে পাঠিয়ে দেন। সেখানে ড. শীতল প্রসাদ ঘোষ আদর্শ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিচয় হয় মূকাভিনয় শিল্পী যোগেশ দত্তের সঙ্গে।

পার্থ ১৯৬৬-১৯৭২ সাল পর্যন্ত কলকাতার যোগেশ দত্ত মাইম একাডেমিতে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে ভারতের চন্দননগর থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকা মিউজিক কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন।

হঠাৎ পার্থ প্রতীমের জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ১৯৭৯ সালে ঢাকার আঁলিয়স ফ্রঁসেজে তৎকালীন ফরাসি রাষ্ট্রদূত লুক মোরি তাঁর একক অভিনয় দেখে এতটাই মুগ্ধ হন যে, মি. মোরির আন্তরিক উদ্যোগে এর পরের বছরই মাইম শিখতে ফ্রেঞ্চ সরকারের বিশেষ বৃত্তি নিয়ে প্যারিস চলে যান পার্থ প্রতীম মজুমদার। সেখানে তিনি ফরাসি দেশের খ্যাতিমান সব মাইম আর্টিস্টদের কাছে দীর্ঘ সাত বছর মূকাভিনয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে মডার্ন কর্পোরাল মাইমের উপর ‘ইকোল দ্য মাইম’ এ শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৮২-১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বিখ্যাত মূকাভিনয় শিল্পী মারসেল মার্সোর কাছে ‘ইকোল ইন্টারন্যাশনালি দ্য মাইমোড্রামা দ্য প্যারিস’ এ মাইমের ওপর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন।

পার্থ প্রতিম মজুমদার পৃথিবীর অনেক দেশে মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথমবারের মতো মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন। পরে ১৯৭৫-১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪৮ বার মাইম প্রদর্শন করেন। এ ছাড়া ঢাকার ড্রামাটিক আর্টস স্কুলে মাইমের শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন থিয়েটার গ্রুপের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কর্মশালা পরিচালনা করেন।



১৯৮২-১৯৮৫ সালে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসের বিভিন্ন থিয়েটারে ২৬টি শো করেন। এ ছাড়া লন্ডনে ২টি, গ্রিসে ২টি ও স্পেনে ২টি শো করেন। ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে তিনি মারসেল মার্সোর সঙ্গে আমেরিকা যান এবং সেখানে মার্সোর নির্দেশনায় ‘ইকোল ইন্টারন্যাশনাল দ্য মাইমোড্রামা দ্য প্যারিস-মারসেল মার্সো’ নামে একটি শো করেন।

১৯৮৫ সালের জুলাইয়ে মারসেল মার্সোর কোম্পানি ও ‘থিয়েটার দ্য লা স্পেহয়ার’ এর সঙ্গে যৌথভাবে ইতালিতে মাসব্যাপী ‘লে কারগো দ্য ক্রেপুসকুল’ ও ‘আবিম’ নামে দুটি মাইমোড্রামা প্রদর্শন করেন। ১৯৮৬ সালে মারসেল মার্সোর তত্ত্বাবধানে পার্থ প্রতিম মজুমদার মাইমের তত্ত্ব বিষয়ক গবেষণা কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন।

এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইম প্রদর্শন করেন। তার মূকাভিনয় নিয়ে কিছু ভিডিও নির্মিত হয়েছে। পার্থ বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন।

১৯৮৬ সালে প্যারিসের ইউনেস্কো হেডকোয়ার্টার্সে ‘বোটম্যান অফ পদ্মা’ (পদ্মা নদীর মাঝি) শিরোনামে তিনি একটি একক অভিনয় প্রদর্শন করেন, যা তাকে বিশ্বব্যাপী মূকাভিনয় শিল্পী হিসেবে পরিচিত করে তোলে।

মাইম, প্যান্টোমাইম, মূকাভিনয়, ইশারা অভিনয়, নৈঃশব্দের কবিতা- এমন হরেক নামে আমরা যে শিল্পটিকে চিহ্নিত করতে চাই, অনেকের বিচারে এমন ব্যঞ্জনাময় শিল্প আর হয় না। তখন তিনি কেবল প্যারিস শহরেই নয়, গোটা ফ্রান্সে মূকাভিনয় শিল্পের এক অনন্য জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠেছেন। সকলে তাকে এক নামে চেনে।



অপূর্ব মঞ্চসজ্জা, তিনি মঞ্চের উপর হাঁটছেন। তাঁর প্রতিটি পদবিক্ষেপ উপস্থিত দর্শনার্থীদের নতুন নতুন গল্প শোনাচ্ছে। কখনও তিনি উজ্জীবিত, কখনও ভাবের সাগরে নিমজ্জিত, হাসির ফোয়ারা ছুটছে, আবার কখনও বা ঝরঝর করে কেঁদেই ফেললেন তিনি। অথচ হলঘরজুড়ে হিরন্ময় নিস্তব্ধতা, তিনি কাঁদছেন আবার কাঁদাচ্ছেন, হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছে সবার, অথচ কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই, যেন পিনপতন নীরবতা গ্রাস করে নেয় উপস্থিত সবাইকে।

পার্থ প্রতিম মজুমদার বাংলাদেশের মূকাভিনয় শিল্পের পথিকৃৎ। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ফ্রান্স সরকারের শেভালিয়র উপাধি পান তিনি। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি ফ্রান্স সরকারের দেয়া এ বিরল সম্মান অর্জন করেন। তার অভিনীত একটি ফরাসি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ২৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। সঙ্গত, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, নাইকি, আইবিএম ও ম্যাকডোনাল্ডের মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানির পণ্যের প্রচারে মডেল হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। তার মাধ্যমেই বাংলাদেশে মূকাভিনয় পরিচিতি লাভ করে।

বাংলাদেশে এইডসের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সচেতনতামূলক আয়োজনেও অংশ নিয়েছেন তিনি। মূকাভিনয় শিল্পে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

পার্থ প্রতিম মজুমদার অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কলকাতা যোগেশ মাইম একাডেমি থেকে ‘মাস্টার অব মাইম’ উপাধি (১৯৮৭), একক মূকাভিনেতা হিসেবে এথেন্স, নিউইয়র্ক, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ (১৯৮৮), লন্ডনে অনুষ্ঠিত বেঙ্গলি লেটারেচার ফেস্টিভালে একমাত্র বাঙালী অতিথি শিল্পী (১৯৮৯), বার্দোতে ও ননত শহরের মেয়র কর্তৃক মেডেল প্রাপ্তি (১৯৯১), নিউইয়র্কের ফোবানা সম্মেলনে বিশেষ সম্মাননা (২০০০), ফ্রান্সের জাতীয় থিয়েটারের মোলিয়ার এ্যাওয়ার্ড (২০০৯), একুশে পদক (২০১০) ও ফ্রান্স সরকারের শেভালিয়র (নাইট) উপাধি (২০১১)।

সম্পর্কিত

আরও পড়ুন

Link copied