আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস উদযাপন

মিলন ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি

প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০২২, ০৭:৫২ পিএম


আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস উদযাপন

ছবিঃ সংগৃহীত

একাত্তর পোস্ট অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

অন্য সবার মতো কন্যা শিশুদেরকেও সকল ক্ষেত্রে সুযোগ দিন। মেয়েদের অধিকার এবং বিশ্বজুড়ে মেয়েরা যে সকল সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি হয় তা স্বীকৃতি দিতে ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ১১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস হিসাবে ঘোষণা করে।

এ বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে, আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস উদযাপনের ১০ বছর পূর্ণ হবে। এ বছরের আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “আমাদের সময় এখন - আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ"।

অর্থাৎ আমাদের সকলের জন্য এখনই সময় আমাদের মেয়েদের সাথে থাকার, তাদের অধিকার পরিপূরনে দায়বদ্ধ বা অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার এবং ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করার যেখানে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে, তাদের নেতৃত্ব ও সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হবে।

আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসের মূল উদ্দেশ্য হল মেয়েদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। অন্য সবার মতো মেয়েদেরকে সকল ক্ষেত্রে সুযোগ দেওয়া, কন্যা শিশুকে ক্ষমতায়িত করা বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তাদেরকে সমর্থন করা এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক পক্ষপাত বা বৈষম্য দূর করা।  

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় এক কোটি মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের প্রায় অর্ধেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট নাই।

অথচ বিদ্যালয়ে মেয়েদের উপস্থিতির জন্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। নির্যাতনের শিকার মেয়েদের মধ্যে দেখা গেছে, ৭২% যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

অপরদিকে নির্যাতনের শিকার ছেলেদের মধ্যে ৬৬% প্রধানত জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হয়। অনেক মেয়ে/কন্যা/ শিশু শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

সারা বিশ্বে মেয়েরা শিক্ষাগ্রহণ, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং নির্যাতন বা সহিংসতামুক্ত জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। প্রতিবন্ধী মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের সহায়তা এবং সেবা/পরিসেবাগুলো পেতে অতিরিক্ত বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামেও আমরা দেখতে পাই আমাদের মেয়েরা অনেক সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি হচ্ছে।

২০১৯-২০২০ সালে, আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ নামক প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের মেয়েরা অনেকেই বাল্য বিবাহের শিকার হচ্ছে (খাগড়াছড়িতে বাল্যবিবাহের হার ২৯% অর্থাৎ শতকরা ২৯ জন মেয়ে এখনো বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে)।

মাসিকের সময় নানা ধরনের কুসংস্কার চর্চার কারনে আমাদের মেয়েরা মর্যাদাহানি ও সহিংসতার শিকার হয়। মেয়েরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না।

নিজের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যেমন, মাসিকের সময় প্যাড কেনা, পছন্দমতো সঙ্গী বাছাই, পড়ালেখার ক্ষেত্রে পছন্দমতো বিভাগ নেয়া, পছন্দমতো আধুনিক পোশাক পরা ইত্যাদি।

পরিবারে মেয়েদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের মতামত নেওয়া হয় না বা তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়না । ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়।

পরিবারে মা-বাবাদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি বা নির্যাতনের ঘটনাগুলো তাদেরকে মানসিকভাবে পীড়া দেয় যা মেয়েরা দেখতে চায় না। অনেক পরিবারে এখনো উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের ক্ষেত্রে মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

অনেক এলাকায় এখনো মেয়েরা কৈশোর বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। বিদ্যালয়গুলোতে মাসিক বান্ধব টয়লেটের অভাব রয়েছে। কোন কোন বিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট থাকলেও সচল নয় বা পর্যাপ্ত উপকরণ নাই (পানি, সাবান, দরজার সিটকিনি, ঢাকনাযুক্ত ঝুড়ি ইত্যাদি)।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এ বছর প্রথমবারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩০০টি কিশোরী ক্লাবে একযোগে এই দিবসটি পালন করা হবে।

যেখানে প্রতিটি ক্লাবে গড়ে ৪০ জন করে মোট ১২০০০ কিশোরী ও যুব নারী (১০-২৫ বছর বয়সী) সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবে। তাদের অধিকার এবং অগ্রাধিকারগুলো আলোচনা এবং বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে তুলে ধরবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সিমাভীর আর্থিক সহায়তায়, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় ১০টি এনজিও সংস্থার মাধ্যমে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে মেয়েদের অধিকারসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সকলের মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অনেক উন্নতি সাধন করেছে।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ১১০ কোটিরও বেশি মেয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত। প্রতিদিন মেয়েরা বাল্যবিবাহ, শিক্ষা গ্রহণে বৈষম্য, সহিংসতা বা নির্যাতন, কোভিড ১৯ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ এবং অপ্রতুল/ অসম স্বাস্থ্যসেবার মতো সমস্যা/চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে চলছে।

তাদের অদম্য ইচ্ছা ও প্রচেষ্টায় তারা সে সমস্ত বাধা ও সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে সাফল্যের সহিত সামনে এগিয়ে চলছে।

মেয়েরা প্রমাণ করছে তারা অপ্রতিরোধ্য। বিশ্বের ৬০ কোটি কিশোরী মেয়েরা বার বার দেখিয়েছে যে দক্ষতা এবং সুযোগগুলো দেওয়া হলে, তারা তাদের নিজ নিজ দেশের/ জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির চালিকাশক্তি ও পরিবর্তনকারী হতে পারে। এমনকি তারা নারী, ছেলে এবং পুরুষসহ সকলের জন্য শক্তিশালী চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে।


এখানে উল্লেখ্য, শত প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের মেয়েরা সম্প্রতি সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ জিতে এসেছে। যেখানে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঋতুপর্ণা চাকমা, আনাই মগিনী, আনুচিং মগিনী, মনিকা চাকমা ও রুপনা চাকমারা বিশাল অবদান রেখেছেন।

দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছেন। সমগ্র দেশবাসীকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন। পুরো দেশবাসী তাদের নিয়ে গর্বিত আজ।

এছাড়াও গত কয়েক বছরে, নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের কিশোরী ও যুব নারীদের মধ্যে বেশ কিছু  ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

যেমন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও বাল্য বিবাহ বন্ধে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।

মাসিক নিয়ে ট্যাবু বা বিধি নিষেধগুলোতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে যেমন, মাসিক হলে একসাথে খাবার খাওয়া (আগে একসাথে খেতে দিতো না), একসাথে ঘুমানো (আগে আলাদা করে মেঝেতে ঘুমাতে হতো), মন্দিরে যাওয়া (আগে নিষেধ করেতো বা নিজে থেকে যেতো না অশূচি মনে করে), পুষ্টিকর খাবার খাওয়া (আগে টক, মাছ, ডিম খেতে নিষেধ করতো) ইত্যাদি।

এখন অনেক পরিবারে বাবা মেয়ের জন্য প্যাড কিনে দিচ্ছে অথচ আগে লজ্জায় এ বিষয়ে কোন কথা বলা যেতো না। অবশ্য এখনো অনেক পরিবারে মাসিক নিয়ে কিছুটা কুসংস্কার চর্চা রয়েছে।

মেয়েরা নিজ হাতে পুন:ব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড তৈরি করে ব্যবহার করছে যা স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

মেয়ে/কন্যা শিশুদের অধিকার পরিপূরণ, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সম্ভাবনাগুলো অর্জন করতে নিম্নে কিছু সুপারিশ দেওয়া হলো:
মেয়ে/ কন্যা শিশুদের করণীয়:


• নিজে অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং অন্যকে সচেতন করতে হবে;
• অদম্য ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং সুযোগগুলোকে সদ্ব্যবহার করতে হবে;
• নিজের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট/ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে এবং নিজের মতামতকে প্রকাশ করতে হবে।  
মা-বাবা/অভিভাবকদের করণীয়:


• মেয়ের/ কন্যা শিশুর প্রয়োজনগুলো শুনতে হবে, বুঝতে হবে এবং তাদের যেকোন প্রয়োজনে সাড়া দিতে হবে বা সাহায্য করতে হবে;
• মেয়ের/কন্যা শিশুর  জীবনের সাথে জড়িত যেকোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার মতামত শুনতে হবে, তার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে হবে; 
• মেয়ে/ কন্যা শিশুকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় সব সময় স্বাগত জানাতে হবে;
• মেয়ে/কন্যা শিশুকে সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার পরিপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে, কেননা, সমস্ত মেয়ে এবং ছেলেদের একই অধিকার রয়েছে এবং প্রত্যেকের একটি মর্যাদাপূর্ন  জীবনযাপনের সুযোগ থাকা উচিত;
• শিক্ষা গ্রহনের ক্ষেত্রে মেয়ে ও ছেলে শিশুর উভয়কে সমান সুযোগ দিতে হবে।
সরকারি/বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহের করণীয়
• মেয়ে/ কন্যা শিশুকে সব ধরনের নির্যাতন বা সহিংসতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে সচেষ্ট থাকতে হবে;
• সম্ভাব্য সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে বা সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা পেতে সহায়তা করতে হবে;
• সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসম্মত ও মাসিক বান্ধব টয়লেট এর ব্যবস্থা করতে হবে;
• সকল ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে এবং নেতৃত্ব বিকাশ ও সম্ভাবনাগুলো অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে;
• উন্নয়ন কর্মসূচিসমূহে মেয়েদেরকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। 

Link copied