ইট-পাথরের ভিড়ে গরীবের এসি মাটির ঘর বিলুপ্তির পথে
প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৩ এএম

ছবিঃ সংগৃহীত
উত্তরবঙ্গের শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত চলনবিলকে ঘিরে সিরাজগঞ্জের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরীবের ‘এসি’ মাটির ঘর আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন-দিন হারিয়ে যাচ্ছে। মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইট-পাথরের আর টাইলস্ দিয়ে নির্মাণকৃত দালান ঘর। তবে মাটির ঘরের শান্তি ইট পাথরের দালান কোঠায় খুঁজে পাওয়া যে বড়োই দায়।
সরেজমিনে এলাকা ঘুরে জানা যায়, জেলার রায়গঞ্জ, সলঙ্গা ও তাড়াশ এলাকার গ্রামগুলোতে বেশ কয়েক বছর আগেও নজরে পড়তো মাটির তৈরি বাড়ি ঘর। একটু সুখের আশায় মানুষেরা ইট-পাথরের দালান তৈরি করলেও বর্তমান যুগে মাটির তৈরি বাড়ি ঘর নির্মাণে কারও আগ্রহ নেই বললেই চলে।
এক সময় এই এলাকার ধনী-গরীব সবাই সেই ঘরে বসবাস করত। বর্তমানে দীর্ঘ স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ইট, বালু আর সিমেন্টের ব্যবহারে দালান কোঠা-অট্টালিকার কাছে হার মানছে এই চিরচেনা মাটির ঘর।
এতে দিন দিন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি বাড়ি-ঘরগুলো বিলুপ্তির পথে। খোঁজ নিয়ে এসব এলাকার মুরুব্বিদের কাছে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মাটির ঘরে বসবাস করে আসতেন। মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে বেশ আগ্রহী ছিল। এঁটেল বা আঠালো মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করতেন। ১২-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় অথবা টিনের ছাউনি দেয়া হতো। শুধু একতলাই নয়, অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত তৈরি করা হতো এই ভাবে মাটি ঘর। এসব মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের প্রায় সময় লাগতো ৪৫ থেকে ৬০ দিন।
মাটির তৈরি ঘরে সৌখিন গৃহিণীরা ঘরের দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে তাদের নিজ-নিজ বসত ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। কিন্তু বর্তমানে ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য বসবাসকারী মাটির ঘর ভেঙ্গে ইট-পাথ, লোহা, সিমেন্টের মিশ্রনে বিলাসবহুল বাড়ি বানানোর দিকেই বেশি ঝুঁকছেন।
যার যেমন সামর্থ্য সেই ভাবে টিনের বেড়া আর টিনের চালা দিয়ে তৈরি করছে ঝকঝকে সুন্দর বাড়ি ঘর। এতে তাদের সম্মান আর শান্তির বসবাস চলছে। তবে মাটির তৈরি এসব ঘর এখন আর চোখে না পড়লেও এটা মানতে হবে যে, এই ঘরগুলো শীত বা গরমে থাকার জন্য বেশ আরামদায়ক ছিলো।
মাটির ঘরে শীতের দিনে ঘর থাকে উষ্ণ আর গরমের দিনে শীতল। তাই মাটির ঘরকে গরিবের এসিও বলা হয়ে থাকে। ইট-পাথরের ভিড়ে এখন আর তেমন চোখে পড়ে না গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য। কারিগররাও এখন এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এই কারিগরা কৃষি জমিতে শ্রম বিক্রি করছেন। আবার কেউ কাজ না পেয়ে স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম শ্রম বিক্রিও করছেন।
তাড়াশ উপজেলার দেশীগ্রাম ইউনিয়নের আড়ঙ্গাইল গ্রামের আব্দুস সালাম (৬০) তিনি জানান, মাটির তৈরি ঘর আরামদায়ক ও দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি বিত্তবানরাও একসময় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। বৃষ্টি বা বন্যায় কোন ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এসব ঘর অনেক বছর পর্যন্ত টিকে থাকে।
একই এলাকার চান মিয়া (৫৫) তিনি বলেন, বাবার তৈরি মাটির ঘরে এখন পর্যন্ত পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। কিন্তু বর্তমানে মানুষের আধুনিক জীবন যাপনের ইচ্ছা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একারনে সবাই মাটির ঘর ভেঙ্গে টিন আর ইটের পাকা-সেমিপাকা ও বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছেন। এতে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর বিলুপ্ত হতে চলে যাচ্ছে।
রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের রূপাখাড়া গ্রামের আব্দুল মজিদ বলেন, প্রায় ৪০ বছর আগে এই ঘর নির্মাণ করেছিলাম। তখনকার সময়ে আমার খরচ হয়েছিল প্রায় ৫ হাজার টাকার মত। আমাদের এই এলাকায় মাটির ঘর এখনো অনেক রয়েছে। বর্তমানে এই ধরনের ঘর তৈরি করতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়।
একই মহল্লার আজিজুল ইসলাম জানান, রায়গঞ্জ-তাড়াশ উপজেলায় আজও অনেক মাটির ঘর আছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বাপ-দাদার তৈরি মাটির ঘরটি প্রতি বছর কিছুটা মাটি দিয়ে সংস্কার করে আজও বসবাস করছেন।
বাংলাদেশ তৃণমুল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি শ্রী শিপন চন্দ্র শিং বলেন, অনেকের মতে আদিবাসীদের আগমন সিরাজগঞ্জে অনাদিকালের। অতীতে বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলের তাড়াশ-রায়গঞ্জ ও সলঙ্গা এলাকায় ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্যে বসবাস করতো। তারা মাটি, বাঁশ ও টিন সংগ্রহ করে নিজেরাই মাটির ঘর তৈরি করতেন। ঘর তৈরির কারিগরের কাজও করতেন। কিন্তু বর্তমানে এসকল ঘরের চাহিদা না থাকা এবং তুলনামূলক ভাবে খরচ বেশি ও ঘর তৈরির কারিগররা অন্য পেশায় যুক্ত হওয়ায় এখন আর মাটির ঘর তেমন একটা দেখা যায় না।
তিনি আরও বলেন, একসময় সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ মাটির ঘর ছিলো। তখনকার চেয়ারম্যান, মেম্বার ও স্থানীয় মাতব্বর এবং সম্পদশালী ধনী লোকেরাও এই মাটির ঘর নির্মাণ করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর বিলুপ্তর পথে।
রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৃপ্তি কনা মন্ডল জানান, রায়গঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় এখনো মাটির ঘর দেখা যায়। অনেকেই সংস্কার করে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ঘরে আজও বসবাস করছেন।
তিনি আরও বলেন, মানুষের অর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে জীবন মানেরও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এতে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালিদের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি এই ঘরের ঐতিহ্য।